আমুদরিয়া নিউজ : শীত এলেই দেশে-বিদেশে মদের চাহিদা চোখে পড়ার মতো বাড়ে। হিমশীতল রাতে শরীর গরম রাখতে এক পেগ রাম বা হুস্কি, অথবা ভদকা খাওয়ার ইচ্ছে তো অনেকেরই হয়। কেউ আবার এক গ্লাস রেড ওয়াইন খেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কারও আবার হোয়াইট ওয়াইনেই নজর বেশি। কেউ তো সিঙ্গল মল্ট অথবা ককটেলে মজে থাকেন। কারণ, অনেকে ভাবেন, শীতে অল্প মদ খেলে শরীর গরম হয়। ঠান্ডা কম লাগে। এমনকি সর্দি-কাশি থেকেও রক্ষা মেলে। কিন্তু এসব ধারণার পেছনে কতটা সত্যতা আছে? স্বাস্থ্য গবেষক ও চিকিৎসকদের মতে, শীতের সময় মদ খেলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিকর দিকই বেশি।
শরীর গরম লাগে ঠিকই, কিন্তু আসলে ঠান্ডা বাড়ায় বিশেষজ্ঞরা অনেকে বলছেন, মদ খাওয়ার পরে রক্তনালীগুলো স্ফীত হয়। এতে রক্ত দ্রুত ত্বকের উপরিভাগের দিকে ছুটে যায়। মুহূর্তের মধ্যে একটু উষ্ণতার অনুভূতি তৈরি হয়। এ কারণেই মদ খাওয়ার পরে অনেকের মনে হয়, বেশ গরম হয়েছে শরীর। আসলে তা হয় না। ত্বকের দিকে অতিরিক্ত রক্তপ্রবাহ শরীরের ভেতরের তাপ বের করে দেয়। তাতে শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা দ্রুত নেমে যায়।
চিকিৎসকদের একাংশের মতে, এই প্রক্রিয়াটি শীতে বিশেষভাবে বিপজ্জনক। যাদের শরীরে তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে—যেমন বৃদ্ধ, শিশু, বা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এমন ব্যক্তি—তাদের জন্য মদ খাওয়া ভীষণ বিপজ্জনক।
তা হলে শীত এলেই মদ খাওয়ার ঝোঁক কেন বাড়ে?
বিষয়টি শুধু শারীরবৃত্তীয় নয়; মনস্তাত্ত্বিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। শীতের সময় দিনের আলো কম থাকে, রাত দীর্ঘ হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কম সূর্যালোকের কারণে অনেক মানুষের মনমেজাজে প্রভাব পড়ে, যা “সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার” (SAD) নামে পরিচিত। মন খারাপ বা অলসতা কাটাতে অনেকে অ্যালকোহলকে বেছে নেন। এ ছাড়া শীতকালে উৎসবও বেশি—ক্রিসমাস থেকে নববর্ষ, পিকনিক থেকে বিবাহোৎসব—যার ফলে মদের সাথে সামাজিকতা বাড়ে।
তবে চিকিৎসকদের কয়েকজনের ধারনা, এই সাময়িক আনন্দ বা সামাজিক অভ্যাস অনেক সময় অজান্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে তা পরিণত হতে পারে আসক্তিতে, যা শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর।
মদ খাওয়ার শীতে যে ঝুঁকি বাড়ে
শীতকালে অ্যালকোহল খাওয়া কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। যেমন,
১. হাইপোথারমিয়ার ঝুঁকি
শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা কমে গেলে হাইপোথারমিয়া দেখা দিতে পারে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় অতি সামান্য পরিমাণ মদ ঝুঁকি বাড়ায়। যদি কেউ বাইরে বা খোলা পরিবেশে মদ খান সেখানে ঝুঁকি আরও বাড়ে।
২. হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে
শীতে হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বাড়ে। অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়াতে পারে সেটা নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এটা হার্টের ওপর চাপ ফেলে। যাদের আগে থেকেই হৃদরোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে সামান্য অতিরিক্ত খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
৩. জল শূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন
শীতকালে তৃষ্ণা বা তেষ্টা কম লাগে বলে অনেকেই জল কম খান। অন্যদিকে অ্যালকোহল শরীর থেকে দ্রুত জল বের করে দেয়। ফলে ডিহাইড্রেশন, মাথা ঘোরা বা ক্লান্তি বাড়তে পারে।

৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানো
অতিরিক্ত মদ খাওয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে। শীতকালে যখন সর্দি-জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাস সংক্রমণ বেশি হয়, তখন মদ খাওয়া সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
শরীর গরম রাখে—এ ধারণা কতটা ভুল?
অনেক দেশে শীতে গরম চা বা কফির সাথে অল্প অ্যালকোহল মিশিয়ে পান করার রেওয়াজ রয়েছে। এ নিয়ে প্রচলিত ধারণা হলো—এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং ঠান্ডা কাটায়। তবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকজন পরিষ্কারভাবে বলেন, মদ খেয়ে গা গরম হওয়াটা সাময়িক ব্যাপারক। ত্বকের উষ্ণতা বাড়ে। কিন্তু, শরীরের অঙ্গগুলোর উষ্ণতা ভেতরে কমে যায়, ফলে ঠান্ডায় দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে। চিকিৎসকেরা অনেকেই বলে থাকেন, গরম অনুভূতির কারণে মানুষ ভুল করে শীতকে কম ঠান্ডা ভাবতে পারে। ফলে অনেকে কম পোশাক পরেন, যা হাইপোথারমিয়ার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
তা হলে শীতে কি একেবারেই মদ খাওয়া যাবে না?
চিকিৎসকদের সকলের অবস্থান কঠোর নয়। তাঁরা মনে করেন, অল্পমাত্রায়, নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ পরিবেশে মদ খেলে ঝুঁকি কম থাকে। তবে কিছু বিষয় অবশ্যই মেনে চলতে হবে—
খালি পেটে মদ না খাওয়া
ঠান্ডা পরিবেশে বাইরে বসে না খাওয়া
পর্যাপ্ত জল খাওয়া
নিজের সহনশীলতার সীমা জানা
যাদের জন্য শীতে মদ খাওয়া আরও বিপজ্জনক
বিশেষ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে শীতে অ্যালকোহল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে মত দেন চিকিৎসকেরা। এদের মধ্যে রয়েছেন—
হৃদরোগী
উচ্চ রক্তচাপের রোগী
শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগী
গর্ভবতী নারী
ডায়াবেটিস রোগী
যাদের ঠান্ডাজনিত অ্যালার্জি বেশি

শরীর গরম রাখতে মদ নয়, কি করা উচিত
বিশেষজ্ঞদের একাংশের পরামর্শ অনুযায়ী, মদের বদলে শীত মোকাবিলায় কার্যকর ও স্বাস্থ্যকর উপায় রয়েছে—
গরম জল, আদা-চা, লেবু-চা বা স্যুপ খাওয়া
পুষ্টিকর খাবার যেমন খিচুড়ি, ওটস, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য
নিয়মিত ব্যায়াম
পর্যাপ্ত জল খান

স্তরযুক্ত গরম পোশাক পরা, তাতে শরীর গরম রাখার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।
শীতকাল যেমন উপভোগের ঋতু, তেমনই এটি শারীরিক নানা ঝুঁকিরও ব্যাপার। আনন্দের মুহূর্তে মদ অনেকের কাছে স্বাভাবিক হলেও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতে মদ খাওয়া, উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। তাই মদের ব্যাপারে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, সঠিক পরিবেশে থাকা জরুরি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, শীত কাটাতে মদ খাব এই ধারনা থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত জরুরি।
প্রতিবেদক : বর্ণা ভট্টাচার্য, নিউজ, কো-র্অর্ডিনেটর, আমুদরিয়া নিউজ