আমুদরিয়া নিউজ : বর্তমানে যে কোনও সম্পর্ককে আজীবন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব কাজগুলোর মধ্যে একটা। সেটা আবার যদি বন্ধুত্ব হয়, তা হলে তো আরও বড় ব্যাপার। চারদিকে বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের গল্পই তো বেশি।
ছোটবেলার বন্ধুত্ব নিমেষে চুরমার হয়ে যায়। একে অপরের মধ্যে কাজ করে হিংসা, অহংকার, রাগ, অভিমান ইত্যাদি। বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতেই অস্বস্তি বোধ করেন অনেকে। তবে সব বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের জন্য হয় না। কিছু বন্ধুত্বে ঘন ঘন দেখা না হলেও তা টিকে যায় সারাটা জীবন। এমনই দুজন বন্ধু হলেন লিওনোর ড্রেগো ও মিশেল অ্যান্ডারসন। তাদের বন্ধুত্বের ভিত ছিল একটা চিঠি। যা বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। তা হলে জেনে নিন তাদের এই অটুট বন্ধুত্বের কাহিনী।
১৯৭০ এর দশকে পর্তুগালে বেড়ে ওঠা লিওনর ছোটবেলা থেকেই আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ভাবতেন যে তার এলাকা থেকে অত দূরে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। তিনি আমেরিকা নিয়ে নানা স্বপ্ন দেখতেন।
১৯৭৫ সালে আমেরিকা থেকে আসা অচেনা, অজানা একজনের চিঠি তার জীবন পাল্টে দেয়। চিঠিটি এসেছিল ১২ বছর বয়সী মিশেলের তরফ থেকে। মিশেল চিঠি লিখে কাল্পনিক নাম ঠিকানা ভেবে পাঠিয়ে দিত। তার পরে কেউ জবাব দিলে বন্ধুত্ব করত।
এভাবেই দুজনের বন্ধুত্বের শুরু।
চিঠিটি যখন এসেছিল তখন লিওনোরের বয়স ছিল ১৫। চিঠিটি পড়ে সে বুঝতে পারে যে মিশেল এলোমেলো ভাবে অনেকজন চিঠিটি পাঠিয়ে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আগের কেউই তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। লিওনোর চিঠিটির জবাব দেয়। ক্রমে তারা একে অন্যকে চিনতে শুরু করে। তাদের পছন্দ গুলিও মিলে যায়। তারা কখনও একে অন্যকে দেখেননি। চিঠির ওপর নির্ভর করেই চলছিল তাদের এই কথাবার্তা।
এভাবেই কয়েকবছর কাটার পর তারা পর্তুগালে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিশেলের পক্ষে বিমান ভাড়া দেওয়া কঠিন ছিল। তাই সে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করে সেই টাকা জমিয়ে প্লেনের টিকিট কিনেছিল।
সালটা তখন ১৯৮০, মিশেল ও লিওনোর প্রথমবার দেখা করেছিলেন। বিমানবন্দরে একে অপরকে যাতে চিনতে পারেন তাই তারা একে অপরের ছবি নিয়ে এসেছিলেন আর কিছু উপহারও এনেছিলেন। প্রায় দুই সপ্তাহ তারা একসাথে কাটিয়েছেন। মিশেল লিওনোর পরিবারের সাথেও দেখা করেছিলেন। স্মৃতিমধুর কয়েকটা সপ্তাহ কাটানোর পর অবশেষে তারা আবার একে অপরকে বিদায় জানায় এবং মিশেল আমেরিকায় ফিরে যায়।
কেটে যায় বেশ কয়েকটা বছর। তবে তাদের চিঠি লেখা বন্ধ হয়নি। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, বিয়ে, সন্তান এই সব কিছুর পরেও তারা তাদের যোগাযোগকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কাগজের চিঠি বদলে গেছে ইমেলে। বন্ধুত্ব বদলায়নি।
২০২২ সাল । মিশেলের বয়স ৪২ বছর। লিওনর একজন শিক্ষিকার চাকরি করতেন। চাকরি সূত্রেই তিনি ও তার স্বামী আমেরিকায় যান এবং পুনরায় এই দুই প্রিয় বন্ধুর দ্বিতীয়বার দেখা হয়। পাঁচদিন তারা একসাথে আনন্দ করে কাটিয়েছিলেন। তারা স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ব্রুকলিন ব্রিজ, সেন্ট্রাল পার্ক প্রভৃতি জায়গায় ঘুরতে যান।
এরপর লিওনোর আমেরিকাতেই চলে আসেন। এখন তারা মোটামুটি কাছকাছি জায়গায় থাকায় হোয়াটসঅ্যাপেই একে অপরের রোজনামচা আদান প্রদান করেন। মিশেল ব্যায়ামের শিক্ষিকা। মিশেল সি এন এন কে জানান, তার সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে যে, পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুজন মানুষ কিভাবে একে অপরের এত ভাল বন্ধু হয়ে উঠল। বর্তমানে দুজনেরই মেয়ে রোমাঞ্চকর ভাবে বার্সিলোনায় রয়েছেন এবং ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছেন।
সমাজ এখন বড্ড জটিল। মানুষের রাগ বেশি, অভিমান বেশি, অহংকারও বেশি। ফলে, বন্ধুত্বকে নিমেষেই শেষ করে দিতে পারে। অথচ এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগে। কিছু মানুষের ধৈর্য এতই কম যে, তারা বাইরের বিশ্বকে জানতে চান না। কাউকে বন্ধু বানাতে চান না।
সে দিক থেকে এই লিওনোর ও মিশেল দৃষ্টান্ত। দুজনেই বলেন, স্বার্থ নিয়ে কোনও সম্পর্কের সূত্রপাত হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য্য