
গন্ধ নাকে এলে কেমন লাগে! যদি সুগন্ধ হয় তা হলে দারুণ লাগে। ভাজা ডিমের গন্ধ পেলে খেতে ইচ্ছে হতে পারে। আবার পচা ডিমের গন্ধ পেলে বমিবমি লাগতে পারে। গন্ধের জন্যই বিরিয়ানিকে ভালবাসেন অনেকে। পশুরা গন্ধের সূত্রে পথ চিনে নিতে পারে।
এবার জেনে রাখুন, আপনি কোন গ্রহে আছেন, সেটা কিন্তু গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারবেন।
অবাক হচ্ছেন ? মনে করুন আপনার চোখ বেধে দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হল কিসের গন্ধ পাচ্ছেন। আপনি খানিক শুঁকে বললেন, ভীষণ দুর্গন্ধ। কীসের বলুন তো ? মনে হচ্ছে ঠিক যেন বিড়ালে হিসি করে দিয়েছে। তা হলে বুধে নেবেন আপনি বৃহস্পতি গ্রহে রয়েছেন।
আবার ধরুন একইভাবে আবার শুঁকে দেখলেন আপনি। এবার গন্ধ মিলল মিষ্টি বাদামের। তা হলে আপনি শনি গ্রহের উপগ্রহ টাইটানের আশেপাশেই কোথাও রয়েছেন। এ তো সবে শুরু। ডিম, পচা ডিম, অ্যালকোহল, স্পিরিট, পোড়া তার – মহাকাশে পাওয়া গন্ধের তালিকাটা বিচিত্র গন্ধের ধরণ দিয়েই পরিপূর্ণ।

নভোচারীদের অভিজ্ঞতাও বিচিত্রই বলা যায়। স্পেসওয়াকের পর নভোচারীরা ধাতব গন্ধ পান, যা অনেকটা ওয়েল্ডিং বা পোড়া ইলেকট্রিক তারের মতো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি স্পেস স্যুটে লেগে থাকা অ্যাটমিক অক্সিজেন কেবিনের ভেতর ওজোনে পরিণত হওয়ার ফল।
এদিকে বেশ কয়েকজন নভোচারী আবার জানিয়েছেন, মহাশূন্যে এক ধরনের বিশেষ গন্ধ রয়েছে, যা তারা স্পেসওয়াকের পর স্পেসশিপে ফিরে এসে অনুভব করেন। এই গন্ধটি ধাতব, পুড়ে যাওয়া মাংস বা বারবিকিউয়ের মতো বলে তারা বর্ণনা করেছেন। তবে সে সময় মাংস খেতে ইচ্ছে হয়েছিল কি না সেটা অবশ্য এখনও গুপ্ত রয়েছে।

মিষ্টি বাদাম বা বারবিকিউয়ের ব্যাপার তো বোঝা গেল। অনেকেই এই গন্ধের টানে মহাকাশের সেই বিশেষ জায়গাগুলিতে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করবেন। তবে দুর্গন্ধের দিকে নিশ্চই পা বাড়াবেন না। তাহলে এখন থেকেই সাবধান হয়ে যান। কারণ সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি হল দুর্গন্ধের রাজা।
দুর্গন্ধের বিচারে বৃহস্পতি ‘স্টিংক বম্ব’ তকমা পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃহস্পতিতে বাতাসে লেয়ারেগুলিতে বিড়ালের প্রস্রাব, পচা ডিম মায় পেট্রোলের গন্ধের সঙ্গে রসুনের ঝাঁঝ মেশানো গন্ধও বর্তমান।

তবে এই বৃহস্পতির এই দশা কেন? সেকি স্নান করে না ? লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টারের অ্যাস্ট্রোবায়োলজি পিএইচডি শিক্ষার্থী ও সুগন্ধি ডিজাইনার মারিনা বার্সেনিলা বলছেন, বৃহস্পতির মেঘের স্তরগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপস্থিত। সবচেয়ে উপরের স্তরটি অ্যামোনিয়া বরফ দিয়ে গঠিত, যার গন্ধ অনেকটা বিড়ালের প্রস্রাবের মতো।
তবে বার্সেনিলা যাই বলুন ভগবান তার মার্জার পোষ্যটিকে হয়তো হেলায় ছেড়ে রেখে দিয়েছেন সেখানে। যাক সে কথা। এরপর বার্সেনিলা জানাচ্ছেন, সেই অ্যামোনিয়ার ঠিক নিচের স্তরেই রয়েছে অ্যামোনিয়াম সালফাইড — যা পচা ডিমের দুর্গন্ধ ছড়ায়। এচডি ১৮৯৭৩৩ বি গ্রহেও এই পচা ডিমে গন্ধ বর্তমান। বলা যায় ? হয়তো দেখা যাবে কিছু অসাধু ডিম ব্যবসায়ী রয়েছেন সেখানে। তবে সে অন্য প্রশ্ন। সবশেষে বলা হচ্ছে, বৃহস্পতির আরও গভীরে গেলে মিলবে ফসফরাস ও জৈব অণু থোলিনের উপস্থিতি, যা পেট্রোলের গন্ধের সঙ্গে রসুনের ঝাঁঝ মেশানো।

তবে ঠিক যেমন বৃহস্পতিতে অসাধু ডিম বিক্রেতা তেমনই গ্রহ কে-২-১৮বি তে অসাধু সবজি ব্যবসায়ী। কারণ এখানে পাওয়া যায় পচা বাঁধাকপির মতো গন্ধ। যা ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) নামক রাসায়নিকের কারণে হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। বলাই বাহুল্য এমন গন্ধযোগ পৃথিবীতে মেলা ভার।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সূত্রের খবর, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী থেকে শুরু করে শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহগুলোর গন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাকাশে গন্ধের অনুভূতি তৈরি হয় রাসায়নিক অণুর মাধ্যমে। পৃথিবীতে যেমন আমাদের নাক রাসায়নিক শনাক্ত করে, তেমনি মহাকাশেও বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের গঠনে থাকা যৌগ বিশেষ গন্ধ তৈরি করে। যেমন, শনির উপগ্রহ টাইটানে মিষ্টি বাদামের গন্ধ হয় হাইড্রোজেন সায়ানাইডের জন্য।
পেট্রোলের গন্ধ হয় ইথেন, মিথেন বা প্রোপেনের জন্য। টাইটানের পৃষ্ঠে মিথেন ও ইথেনের লেক ও নদী আছে। এছাড়াও নাইট্রোজেন ও মিথেনের বিক্রিয়ায় তৈরি জৈব যৌগ এবং অন্যান্য সালফার যৌগ পচা মাছের গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করা হয়। আবার মিল্কি ওয়ের স্যাজিটেরিয়াস বি ২ মেঘের এর মধ্যে থাকা ইথানলের গন্ধ মদ বা অ্যালকোহলের মতো। মিথানলের গন্ধ কাঠের স্পিরিট বা পেট্রোলের মতো ঝাঁঝালো।

এদিকে আবার এই গন্ধ নিয়ে ধন্দ কাটাতেই লেগে রয়েছে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)। এটি মহাকাশের অনেক গন্ধ শনাক্ত করতে সাহায্য করছে। ২০২২ সালে এটি এক্সোপ্ল্যানেট ডব্লিউএএসপি-৩৯ বি-এর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড শনাক্ত করে। এছাড়াও, এটি কে২-১৮বি গ্রহে ডাইমিথাইল সালফাইডের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে, যা পৃথিবীতে সামুদ্রিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত।

মজার বিষয় হল মহাকাশের নানা গন্ধ থাকলেও পৃথিবীর গন্ধই সবচেয়ে প্রিয় নভোচারীদের কাছে। নভোচারী হেলেন শারম্যান ১৯৯১ সালে কাজাখস্তানে অবতরণ করার পর তাজা বাতাস ও ভূমির ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘এটি ছিল অদ্ভুত সুন্দর। এক কথায় অনবদ্য।
মহাকাশের গন্ধ শুধু বিজ্ঞানীদের কৌতূহলই মেটায় না, এটি মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনেও সাহায্য করে। হয়তো একদিন এই গন্ধই প্রমাণ করবে, আমরা মহাবিশ্বে একা নই।
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী, আমুদরিয়া নিউজে ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।