
আমুদরিয়া নিউজ : ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু হিরোশিমার আগুন এখনো কোরিয়ানদের হৃদয়ে জ্বলছে—নির্বাক ক্ষোভ ও অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মতো।
তা নিয়েই খবর আজ।
কেউই দায়িত্ব নেয় না,’ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন ৮৩ বছর বয়সি শিম জিন-তায়ে। ‘যে দেশ বোমা ফেলেছিল, সে নয়। যে দেশ আমাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সে নয়। আমেরিকা কখনো ক্ষমা চায়নি। জাপান ভান করে কিছু জানে না। কোরিয়াও এর চেয়ে ভালো নয়। তারা শুধু দোষ চাপিয়ে দেয়। আর আমরা রয়ে যাই একাকী।’
এই কথাগুলো প্রমাণ করে শিম মোটেই স্মৃতিমেদুর নন। বরং পুরোনো স্মৃতি ভুলে যেতেই যেন ব্যস্ত তিনি। কিন্তু সে জ্বালা মেটে না। গরম লোহায় যেমন রূপকার নকশা খচিত করেন সেই যন্ত্রণার দিনগুলো যেন শিমের মতো মানুষদের হৃদয়ে সেভাবেই খচিত হয়ে গিয়েছে। শত আনন্দের মূহুর্তের মধ্যেও সে স্মৃতিগুলো দুঃস্বপ্নের মতো বারে বারে দেখা দিয়ে যায়। সেই লৌহখচিত দুঃস্বপ্নগুলোয় জং পড়ে না। ম্লান হয় না। লোহার মতোই যেন চিরতরে রয়ে যায় শিরায় শিরায়!

শিম জিন-তায়ে
কী ছিল এই দুঃস্বপ্নের নেপথ্যে ? ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। হিরোশিমার আকাশ ছিঁড়ে নামছিল একটি পারমাণবিক বোমা—‘লিটল বয়’। সেদিন ঘড়ির কাঁটাও হয়তো দ্রুত ঘুরেছিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে শহরটি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। বিস্ফোরণের শক্তি ছিল ১৫ হাজার টন টিএনটির সমান। মুহূর্তে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। পরবর্তী কয়েক মাসে রেডিয়েশন, পুড়ে যাওয়া এবং জলের অভাবে আরও কয়েক হাজার মানুষ মারা যান। ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। কিন্তু যারা বেঁচে ফিরেছিলেন তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। যারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও সমাজে জায়গা পাননি। ক্ষতিগ্রস্থদের শরীর জুড়ে ছিল বোমার ক্ষত। আর মন জুড়ে ছিল সময়ের কালো হাতছানি।

সেইদিন ছোট্ট মেয়ে লি জং-সুন যাচ্ছিলেন স্কুলে। আজ ৮৮ বছর বয়সেও তিনি হাত নেড়ে স্মৃতিটা দূরে সরানোর চেষ্টা করেন। ‘আমার বাবা হঠাৎ দৌড়ে এসে বললেন, পালাও! রাস্তা ভর্তি ছিল মৃতদেহে। আমি শুধু কেঁদেছিলাম, থামতেই পারিনি,’ আবেগে বলেন লি। লি জং-সুন এখন ক্যান্সার, পারকিনসনস, এবং হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। তার ছেলে হো-চাংও কিডনি বিকলতায় আক্রান্ত। তিনি মনে করেন, এই রোগ রেডিয়েশনের প্রভাবের ফল, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা কঠিন।

লি জং-সুন
২০১৯ সালে কোরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো একটি সমীক্ষা চালায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্বিতীয় প্রজন্মের বোমা বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা, হৃদরোগ এবং রক্তাল্পতার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। তাই আজও দুর্ঘটনাগ্রস্তরা সেই পুরোনো ক্ষত বয়ে চলেছেন।
এই বিপর্যয়ে প্রায় ২০% নিহত ছিলেন কোরিয়ান। ৩৫ বছর ধরে জাপানের উপনিবেশ থাকা কোরিয়া থেকে প্রায় ১.৪ লক্ষ মানুষ কাজের জন্য, অথবা জোরপূর্বক, হিরোশিমায় গিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই যুদ্ধকালীন বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিস্ফোরণের পর মৃতদেহ সরানো ও ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কারের কাজও মূলত তাদের ওপর চাপানো হয়। হাপচিয়ন অঞ্চলের অনেক মানুষ সেই সময় জাপানে পাড়ি দিয়েছিলেন। যুদ্ধোত্তর সময়ে জাপানিরা পালিয়ে গেলেও কোরিয়ানদের থাকতে হয়েছিল শহরে, রেডিয়েশনের মধ্যে। ফলে মৃত্যুহার কোরিয়ানদের মধ্যে ছিল অনেক বেশি। ৫৭.১ শতাংশ। সর্বসাকুল্যে ৩৩ শতাংশের কাছাকাছি।

দ্বিতীয় প্রজন্মের বেঁচে থাকা হান জিওং-সান নিজেকে টেনে না টেনে হাঁটতে পারেন না এবং নিজের পরিবারের কাছ থেকেও কলঙ্কের মুখোমুখি হয়েছেন।
যুদ্ধের পর প্রায় ২৩ হাজার কোরিয়ান দেশে ফিরলেও, সেখানে তারা পাননি স্বাগত। বিকৃত শরীর, পোড়া মুখ—সবই তাদের সামাজিকভাবে বঞ্চিত করেছে। অনেকেই বিয়ে করতে পারেননি, গ্রামে গ্রামে তাদের ছুঁয়ে দেখারও কেউ ছিল না। লি বলেন, ‘আমার চোখের সামনে দেখেছি—পোড়া মুখের মানুষকে বিয়ে থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ শুধু প্রথম প্রজন্ম নয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মও বহন করছে সেই যন্ত্রণা। হান জং-সুন, যিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের ভুক্তভোগী, হাঁটতে পারেন না। তার ছেলে জন্মগতভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘আমার অসুখই প্রমাণ, আমার ছেলের অক্ষমতাই প্রমাণ। তবু সমবেদনা নেই।’

হ্যাপচিয়নের একটি স্মারক কক্ষে ১,১৬০টি কাঠের ফলক রয়েছে – প্রতিটিতে পারমাণবিক বোমায় নিহত একজন কোরিয়ানের নাম লেখা আছে।
২০২৫ সালের ১২ জুলাই, প্রথমবারের মতো হিরোশিমার সরকারি প্রতিনিধিরা হাপচিয়নে গিয়ে ফুল দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। জাপানি শান্তি কর্মী জুনকো ইচিবা বলেন, ‘ক্ষমা ছাড়া শান্তি অর্থহীন। ইতিহাসের এই অধ্যায় জাপানি পাঠ্যবইয়ে নেই, আর এই অদৃশ্যতাই অন্যায়কে গভীরতর করে।’ রেডক্রস কর্মকর্তা হো জং-গু বলেন, ‘বেঁচে থাকা মানুষদের জীবদ্দশায় প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। দেরি করলে আর কেউ থাকবে না গল্প বলার।’ শিম জিন-তায়ের কথায়, ‘টাকা নয়, স্মৃতিই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শরীর যা মনে রেখেছে, পৃথিবীকে তা মনে রাখতে হবে। না হলে ইতিহাস আবার নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে।’
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী, আমুদরিয়া নিউজে ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।