
সকাল ১০টা ৩৯ মিনিট। চেক প্রজাতন্ত্রের এক বিয়ার কারখানার বারে হাজির হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং আমেরিকার ২০ জন ব্রুয়ার। তাঁদেরই একজন, অস্ট্রেলিয়ার লিয়াম তাহেনি বললেন, ‘এখানকার সাধারণ মানুষও বিয়ারের বিষয়ে এমন জ্ঞান রাখেন, যা আমাদের দেশে কেবল পেশাদার ব্রুয়াররাই রাখেন।’ তার কথাটা শুনে কৌতুহল হওয়ারই কথা। কী করতে তিনি ও তার মতো ব্রুয়াররা সুদূর পথ অতিক্রম করে এসছেন?
তারা কী বিয়ার আগে খাননি?
উত্তরটা জানতে গেলে জানতে হবে চেক প্রজাতন্ত্রের উদ্যোগের কথা।

একটা দেশ কীভাবে নিজের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে পারে কূটনীতির হাত ধরে ? কেউ বলে খাবারের মাধ্যমে, কেউ বলে সিনেমা দিয়ে। কিন্তু চেক প্রজাতন্ত্র বলছে—বিয়ার দিয়েও সম্ভব! আর সেই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই তারা চালু করেছে অভিনব এক উদ্যোগ—‘বিয়ার কূটনীতি’। তাতে চেক প্রশাসেনর তরফে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ ও আগ্রহী ব্রুয়ারদের ডেকে এনে তাদের চেক বিয়ার সংস্কৃতি ঘনিষ্ঠভাবে বোঝানো, শেখানো এবং অভিজ্ঞতা দেওয়া হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতেই চেক বিয়ারের কলাকৌশল শিখতে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মার্কিন ব্রুয়ার বা বিয়ার প্রস্তুতকারকরা। উদ্যোগের নেপথ্যে চেক প্রজাতন্ত্রের কৃষি মন্ত্রক।

এই ব্রুয়ারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পাঁচ দিনের কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল মাইক্রো ও ম্যাক্রো ব্রুয়ারি সফর, হপস চাষ পরিদর্শন, বিখ্যাত চেক ব্রুয়ারদের সঙ্গে আলাপ, বিয়ার ঢালার পদ্ধতি শেখা, চেক বিয়ার ইতিহাস ও স্বাদের পাঠ। এখানে বলে রাখা ভালো, মাইক্রো ও ম্যাক্রো ব্রুয়ারি হল যথাক্রমে ছোট ও বড় বিয়ার তৈরির কারখানা।
আর হপস হল বিয়ার তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান। এর থেকেই স্বাদ, গন্ধ ও তিক্ততা বিয়ারে যোগ করা হয়। হলি মাউন্টেন ব্রুয়ারির মেগান মাইকেলস বলেন, ‘চেক বিয়ার তৈরি করা সহজ নয়। এরা শতাব্দী ধরে এটা করছে। তাই এর আসল স্বাদ পেতে হলে চেক প্রজাতন্ত্রে আসতেই হবে।’

এই বিয়ার কূটনীতি সম্বন্ধে বলতে গেলে গোড়ার কথা বলতেই হয়। চেক প্রজাতন্ত্র মানেই বিয়ারের দেশ। এখানকার পশ্চিমাঞ্চল বোহেমিয়াতে ৯৯৩ সাল থেকেই বিয়ার তৈরির চল রয়েছে।
এ দেশের মানুষ মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি বিয়ার খান। এমনকি অনেক জায়গায় বিয়ার জল থেকেও সস্তা! তবু আশ্চর্যজনকভাবে, এত ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও চেক বিয়ার বরাবরই কিছুটা অবহেলিত ছিল। বেলজিয়াম বা জার্মান বিয়ারের তুলনায় বা সাম্প্রতিক আইপিএ-র উত্থানে চাপা পড়ে গিয়েছিল চেক স্বাদ। কারণ ? একদিকে ছিল কমিউনিস্ট যুগের ৪১ বছরের পর্দা, অন্যদিকে আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জ।

এরপর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা চেক বিয়ারের বিস্তৃতি। ২০১৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের কৃষি মন্ত্রক এক নতুন উদ্যোগ নেয়। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিয়ার প্রস্তুতকারকদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, চেক বিয়ার সংস্কৃতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, বিদেশি ব্রুয়ারদের মাধ্যমে চেক বিয়ারের সঠিক স্বাদ ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
কানাডার এক ব্রুয়ারির মালিক রায়ান মনক্রিফ বলেন, ‘আমাদের দেশে চেক বিয়ার পাওয়া গেলেও সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। একমাত্র এখানে এসে আসল স্বাদ বোঝা যায়।’
তাহলে প্রশ্নটা হল চেক বিয়ারের স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না কেন ? কারণটা হল বিয়ার নাকি এক্সপোর্ট করার সময় বাসী হয়ে যায়। তাই ব্রুয়াররা বলছেন, চেক বিয়ারের আসল স্বাদ বোঝার একটাই উপায়—চেক প্রজাতন্ত্রে এসে খেতে হবে। পক্ষান্তরে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় বিয়ারের স্বাদটা অনেক সময়েই পুরনো লাগে। চেকের জল, আবহাওয়া, হপস সব মিলিয়ে তৈরি হয় আসল চেক ‘ল্যাগার’।

বিদেশিদের কী কী শেখানো হয় ? চেক সরকার শুধু বিয়ার খাওয়াতে ডাকে না। তারা শেখায় বিয়ারের পেছনের বিজ্ঞান ও শিল্প। এখানে এলে বোঝা যায় বিয়ার গ্লাসে ঢালাও এক ধরনের শিল্প। চেক বিয়ারের ফেনাও অনেক বড় ব্যাপার। সঠিকভাবে ফেনাসহ বিয়ার ঢাললে স্বাদ অনেক বেশি ভালো লাগে।
চেক শহর প্লজেন-এ ‘লুকর’ নামে একটি সংস্থা রয়েছে। তারা এমন বিয়ার ট্যাপ বানায় যেগুলো দিয়ে বিয়ার ঢাললে ফেনা ঠিকঠাক থাকে। এই ট্যাপ ২০১৫ সালে তারা প্রথম উত্তর আমেরিকায় বিক্রি শুরু করে। তখন ছিল মাত্র ১২টি। এখন বছরে ২০০০-এর বেশি বিক্রি হয়—এই ‘বিয়ার কূটনীতি’-র ফলেই।
এখানেই শেষ নয়। চেকে বিয়ারের কারিকুরি শেখানোর স্কুলও আছে! প্রাগ শহরে ‘ইনস্টিটিউট পিভো’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে শেখানো হয়। কীভাবে বিয়ার ঢালতে হয়, কীভাবে বিয়ার পরিবেশন করতে হয়, প্রাগে বিয়ারের ঐতিহ্য কী ইত্যাদি। সেখানে একজন প্রশিক্ষক বলেন, ‘ভুলভাবে বিয়ার ঢালা মানে পুরো স্বাদটাই নষ্ট করে দেওয়া। আমরা এটা শেখাচ্ছি, যাতে অন্য দেশেও কেউ বিয়ারকে সম্মান দেয়।’

পাশাপাশি বিয়ার দিয়ে দেশের পরিচিতিও বাড়ছে। এই কৌশল অনেকটা থাইল্যান্ডের মতো।
ওরা ২০০২ সালে ‘গ্লোবাল থাই’ প্রোগ্রাম চালু করেছিল। তারপরই সারা বিশ্বে থাই রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনই, চেক প্রজাতন্ত্র এখন বিয়ারের মাধ্যমে নিজের পরিচিতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের নানা দেশে এখন তৈরি হচ্ছে চেক-স্টাইল বিয়ার। আর মানুষ জানছে—চেক বিয়ার মানে আলাদা একটা অভিজ্ঞতা। এটাই চেক প্রজাতন্ত্রের ‘বিয়ার কূটনীতি।’ শান্তিপূর্ণ, স্বাদে ভরা, ও বিশ্বকে সংযুক্ত করার এক অভিনব পথ।
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী। আমুদরিয়া নিউজে ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।