আমুদরিয়া নিউজ : বয়স তখন ১২। নাম লো মান হুং। কাঁধে ঝোলানো একটি ফিল্ম ক্যামেরা। লক্ষ্য—ভিয়েতনাম যুদ্ধের চিত্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। মন স্থির। এক লক্ষ্যে অটল। এমনকি ভয়ঙ্কর ভিয়েতনাম যুদ্ধের দামামাও তাঁর কিশোর মনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পারেনি। একটার পর একটা ছবি জায়গা করে নিয়েছে তার ফিল্মের নেগেটিভে। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, সেনাদের গোলা বর্ষণ, যুদ্ধে ছিন্নবিচ্ছিন্ন এলাকার প্রতিচ্ছবি। কিছুই বাদ যায়নি তার ফ্রেম থেকে।
শুধু সেনাদের লড়াই নয়, সাধারণ মানুষের কান্না, ভয়, উদ্বাস্তু জীবন ও ধ্বংসস্তূপের ছবিও ছিল সেই অসম সাহসী কিশোরের এক্তিয়ারে। তার ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে এক মা, যার কোলে মৃত সন্তান; এক বৃদ্ধ, যিনি নিজের পোড়া ঘরের সামনে বসে আছেন নির্বাক হয়ে। আরও কত কী। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেই জ্বলন্ত দলিল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
একসময় সায়গনের অলিতেগলিতে ঘোরা কিশোর কীভাবে বেছে নিয়েছিল তার প্রতিবাদের ভাষা ? কীভাবেই বা সে এই অসাধ্য সাধন করল ?
শুরুর কথা দিয়েই শুরু করা যাক। লো মান হুংয়ের বাবা লো ভিন জন্মেছিলেন উত্তর ভিয়েতনামে। ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা ও সাহিত্য পড়েছিলেন। কিন্তু জীবিকার তাগিদে পেশা হিসেবে বেছে নেন ফটোগ্রাফি। ৪৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই কমিউনিস্ট বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে সায়গনে চলে যান স্ত্রীকে নিয়ে। ৪৪ বছর ক্যামেরার পেছনে কাটানো মানুষটি ছিলেন সায়গনের অন্যতম প্রবীণ সাংবাদিক। এরপর লো মান হুয়ের জন্ম হয় সায়গনে। বাবার কাছেই ছোট্ট হুং আলো-ছায়ার খেলা শিখেছিল। ক্যামেরার ক্লিক ছিল তার জীবনের ছন্দ। বাবা আহত হওয়ার পর মাত্র ১০-১১ বছর বয়সেই হুং বাবার কাজে হাত লাগায়। সকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাবা-ছেলে মিলে কাজ করত, সপ্তাহে সাত দিন। কখনও সরকারিভাবে ডিউটি, কখনও বিয়ে বা অনুষ্ঠানের ছবি, আবার কখনও রাস্তায় আগুন বা বোমাবর্ষণের চিত্র—সবই কভার করত এই জুটি।
১৯৭২ সাল। তখন ভিয়েতনাম আমেরিকান বোমা পড়ছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু। শহরের পাড়ায় পাড়ায় মৃত্যু। তার মাঝেই লো বেছে নেয় তার ভবিষ্যৎ। ছিল একটি পুরোনো মডেলের ফিল্ম ক্যামেরা। সম্ভবত বাবার কাছে সে সেই ক্যামেরা পেয়েছিল। হাতে সেই ক্যামেরা নিয়েই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধের ভেতরে।
তার মাথায় না ছিল প্রেস হেলমেট, না কোনো প্রোটেকশন। কিন্তু ছিল চোখে আগুন আর একটাই লক্ষ্য। সব দেখাব, সব দেখবে পৃথিবী। লো কিশোর হলেও তার সাহস ছিল পেশাদারদের চেয়েও বেশি। সে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকে পড়ত। যেখানে হয়তো ছিল বন্দুক তাক করে হামলারত সেনা অথবা ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে ভরপুর যুদ্ধক্ষেত্র।
একবার একটি গ্রামে বোমা পড়ে। সবাই পালাচ্ছে। লো তখন ঢুকছে। তার ছবিতে ধরা পড়ে—এক জ্বলন্ত বাড়ির পাশে ছাই হয়ে যাওয়া খেলনা। পাশে কাঁদতে থাকা একটি শিশু। এই ছবিই পরে ছাপা হয় আমেরিকান সংবাদপত্রে। শিরোনাম হয়, ‘থ্রু দ্য আইস অফ এ বয়।’ এরপর লো মান হুংয়ের তোলা ছবি একটার পর একটা ছাপা হতে থাকে। টাইম, ওয়াশিংটন পোস্ট, লা মন্ডে, এমনকি সোভিয়েত পত্রিকাতেও।
তাঁর ক্যামেরায় উঠে এসেছিল :
রাস্তার মাঝখানে আগুনে পুড়তে পুড়তে দৌড়তে থাকা শিশু
হাসপাতালে কাতরানো আহত নাগরিকদের চিৎকারের দৃশ্য
এক সৈন্য, যার মুখে বিস্ময় আর হাতে পোড়া পতাকা
এইসব ছবি শব্দ ছাড়াই বলে দিয়েছিল যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
কিন্তু শেষে কী হল?
লো মান হুংয়ের খোঁজ মেলে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। সায়গন পতনের আগে তাঁকে শেষবার দেখা যায় হেলমেট পরে, ক্যামেরা হাতে, দক্ষিণ ফ্রন্টের দিকে যেতে।
তারপর?
নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। অনেকে বলেন, সে হয়তো বন্দি হয়েছিল। কেউ বলেন, পালিয়ে গিয়েছিল বিদেশে। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, লো মান হুং হয়ত সেদিন নিজের শেষ ছবিটা তুলেছিল… নিজের মৃত্যুর আগে। তার ছবি আজ ইউনেস্কো থেকে নিউ ইয়র্ক মিউজিয়াম অব ফটোগ্রাফি, সর্বত্র সংরক্ষিত। পরবর্তীতে ভিয়েতনাম সরকার তাকে ‘ওয়ার হিরো অফ ইমেজ’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
সম্প্রতি লো মানের উত্তরসূরিরা একটি ছোট প্রদর্শনী এবং কিছু প্রকাশনা নিয়ে ভাবছেন। তাতে হুং-এর তোলা ছবি এবং তার জীবনকাহিনী তুলে ধরা হবে। লো মান হুংয়ের জীবন যাঁরা দেখেছেন তাদের কথা ও স্মৃতিচারণা একত্রে রাখা হচ্ছে।
তাঁর স্ত্রী ত্রান কাম থু পরিবারের কাছে ঐতিহ্য-স্বরূপ স্মৃতিচিহ্ন ও তথ্য ভাগ করে দিয়েছেন। জানা যায়, তার দুই কন্যা রয়েছে এবং বর্তমানে তাঁরা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছেন। মাঝে মাঝে আগ্রহীদের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেন। এ ছাড়াও হুংয়ের নষ্ট হওয়া নেগেটিভগুলোর পুনরুদ্ধারে তার পরিবার সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে। ঐতিহাসিক ছবিগুলো ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা চলছে, যাতে হুংয়ের তোলা সাহসিকতার মুহূর্তগুলো হারিয়ে না যায়।