
আমুদরিয়া নিউজ : মানুষের সমুদ্রের সাথে সম্পর্ক বহু পুরনো। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ শামুক, শৈবাল কিংবা মুক্তোর জন্য সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিত। আজও সেই প্রবৃত্তি টিকে আছে, তবে এখন তা পরিণত হয়েছে এক রোমাঞ্চকর খেলায়—ফ্রি ডাইভিং।
ফ্রিডাইভিং হলো এমন এক ধরনের ডাইভিং যেখানে কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার বা যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই, কেবল ফুসফুসের বাতাস নিয়ে ডুব দেওয়া হয়। এক নিঃশ্বাসে গভীর নীলের রহস্যে হারিয়ে যাওয়া—এটাই এই খেলার মজা এবং চ্যালেঞ্জ।
এই খেলায় সবচেয়ে আলোচিত নাম ইতালির আলেসিয়া জেকিনি। ২০২৩ সালে তিনি এক নিঃশ্বাসে ১২৩ মিটার গভীরে ডুব দিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। ডুব দেওয়ার আগে তিনি পৃষ্ঠে ভেসে থাকেন, মনকে শান্ত করেন, কোনো অযথা চিন্তা মাথায় আসতে দেন না।
জেকিনি বলেন, “শেষ নিঃশ্বাসটি হয় সবচেয়ে বড়, কারণ এটিই আমাকে গভীরে নিয়ে যায়।” শুরুতে তিনি দ্রুত পা চালিয়ে নিচের দিকে যান, কিন্তু ২৫ মিটার নামার পর গতি কমিয়ে দেন, আর ৬০ মিটার গভীরে পৌঁছালে শরীর একেবারেই স্থির হয়ে যায়। এই মুহূর্তটিকে বলা হয় ফ্রি-ফল। যখন ডুবুরি কোনো শক্তি খরচ না করে জলের টানে নিচের দিকে ভেসে যায়। জেকিনির ভাষায়, “এটা যেন জলের ভেতর উড়ে যাওয়ার মতো।”
গভীরে নামার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলো ম্লান হয়ে যায়, চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়। এই সময় ডুবুরিরা অনুভব করতে পারেন নাইট্রোজেন নারকোসিস। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে ফুসফুসে সঞ্চিত নাইট্রোজেন গভীর চাপের কারণে রক্তে প্রবেশ করে এবং মস্তিষ্কে মাতাল ভাব, বিভ্রম বা অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। যদিও এটি রোমাঞ্চকর মনে হয়, আসলে এটি বিপজ্জনকও হতে পারে। জেকিনি বলেন, ‘ভাবার প্রয়োজন নেই। শুধুই অনুভব করতে হয়। এভাবেই বাঁচতে হয়।’
এই গভীর ডুবের পেছনে আছে মানুষের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা, যার নাম ডাইভ রেসপন্স। জলে নামার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের শরীরে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। এতে হৃদস্পন্দন ধীর হয়ে যায়, হাত-পায়ের রক্তনালী সংকুচিত হয় এবং রক্তপ্রবাহ মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের দিকে বেশি কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে অক্সিজেনের ব্যবহার কমে গিয়ে শরীর দীর্ঘ সময় জলর নিচে টিকে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে যে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অগভীর সমুদ্রের জন্য তৈরি। ঠিক যেমন ওটার বা বিবারের মতো প্রাণী।
আসলে এই দক্ষতা মানুষের মধ্যে নতুন কিছু নয়। ৯০,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা শামুক সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের তলদেশে নামত। একইভাবে জাপানের ‘আমা’ নারীরা হাজার বছর ধরে মুক্তো ও শৈবাল সংগ্রহ করছে। এ ছাড়াও কোরিয়ার হেনিও নারীরা এখনো সমুদ্র থেকে সি-ফুড সংগ্রহ করে, এমনকি গর্ভাবস্থায়ও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজাউ জনগোষ্ঠী প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সমুদ্রতলে কাটায়। গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের প্লীহা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বড়, যা অতিরিক্ত অক্সিজেন সংরক্ষণ করে। প্রকৃতির দেওয়া এক ধরনের ‘জৈব অক্সিজেন ট্যাংক।
তবে মানুষের ডুব দেওয়ার ক্ষমতা সিল মাছের মতো নয়। সিল জলে নামলেই হৃদস্পন্দন কয়েক সেকেন্ডে ১২০ থেকে ৪-এ নেমে যায় এবং তারা অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষও অক্সিজেনের ঘাটতি ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের চাপ সহ্য করতে শিখে যায়। এজন্য এলিট ফ্রিডাইভারদের হৃদস্পন্দন ও অক্সিজেন সহনশীলতা অনেক সময় সিল বা ডলফিনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
তবে এই খেলা বিপজ্জনক। ২০১৭ সালে জেকিনি তার বন্ধু ও সেফটি ডাইভার স্টিফেন কীনানকে হারান এক দুর্ঘটনায়। কিন্তু গভীর সমুদ্রের প্রতি তার টান তাকে থামায়নি। জেকিনি বিশ্বাস করেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষ নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, অনেক মানুষের মধ্যেই সমুদ্রের প্রতি এক ধরনের প্রাকৃতিক টান আছে। নীল জল আমাদের মস্তিষ্কে সুখের অনুভূতি জাগায়। হয়তো আমাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে সেই প্রাচীন স্মৃতি, যখন মানুষও ছিল সমুদ্রের সন্তান। জেকিনির ভাষায়, ‘পৃষ্ঠের নিরাপত্তা ছেড়ে আমি গভীরে যাই, কারণ সেই জগৎ এত কাছে, তবু এত ভিন্ন।’
সমুদ্রের গভীর নীল আমাদের টানে। ইতালির জেকিনির প্রশ্ন হল, আমরা কি কেবল স্থলেরই প্রাণী, নাকি সমুদ্রও আমাদের ঘর?
হয়তো আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে একটুকরো গভীর নীলের প্রাণ।
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী। আমুদরিয়ায় ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।