আমুদরিয়া নিউজ : এটা সত্যিই ভারতীয় সাহিত্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, একজন ভারতীয় মুসলিম নারী লেখক প্রথম বুকার পুরস্কার পেলেন। তাঁর নাম বানু মুশতাক। তাঁকে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন “হার্ট ল্যাম্প” এর জন্য মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই জয় বিশ্ব জুড়ে প্রান্তজনের কণ্ঠস্বরের আরও ব্যপ্তি ঘটাবে।
হার্ট ল্যাম্প, একটি সুন্দর সংকলন, যাতে ভারতীয় মুসলিম এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন সংগ্রাম এবং আধ্যাত্মিক সহ্যক্ষমতার চমৎকার মিশেল রয়েছে। গল্পগুলি গ্রামীণ এবং শহুরে দুই প্রেক্ষাপটই সামনে এনেছে। একজন নারীর জীবন্ত অভিজ্ঞতা, বাস্তুচ্যূত হওয়ার যন্ত্রণা এবং প্রতিরোধের নীরব শক্তিকে জীবন্ত করে তোলে গল্পগুলো।
লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার ঘোষণা করে, জুরি বোর্ড বলেছে, এই গীতিমূলক গদ্য, এর আবেগের গভীরতা এবং এ যাবৎ দুনিয়ার নানা গল্পে যে বিষয়গুলো আসেনি, সেই বিষয়গুলির নির্ভীক অন্বেষণ বলে আমরা মনে করি। দুজি বোর্ড বলেছে, এই নীরব গল্পের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী আলো, যা বিশ্বব্যাপী থাকা প্রান্তজনদের আলোকিত করে দেয়।
পুরস্কার গ্রহণের পর মুশতাক সংবাদ মাধ্যমে জানান, আমার দাদীর কোল থেকে, পুরনো দিল্লির গলিপথ থেকে শুরু করে ভারতের প্রত্যন্ত শহরগুলিতে আমার বয়ে আনা গল্প থেকেই হার্ট ল্যাম্পের জন্ম। এই পুরস্কার আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের ভাষা এবং আমাদের সত্যের স্বীকৃতি। এটি প্রতিটি মেয়ের জন্য যারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে কলম ধরেছে।
বিশিষ্ট ভারতীয় লেখিকা এবং বুকার পুরস্কার বিজয়ী অরুন্ধতী রায় মুশতাকের স্বীকৃতিকে “সাহিত্যিক ন্যায়বিচারের একটি মুহূর্ত” বলে অভিহিত করেছেন। “এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত জয় নয় বরং সাহিত্যে বহুত্ববাদের একটি শক্তিশালী দাবি,” তিনি বলেন।
বানু মুশতাকের জন্ম ৩ এপ্রিল, ১৯৪৮ সালে। ভারতের কর্নাটক রাজ্যের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি জীবিকাসূত্রে একজন আইনজীবী। এ ছাড়া সমাজকর্মী হিসেবে বিখ্যাত। তিনি কন্নড় ভাষায় লেখেন। কন্নড় ভাষায় এর আগে কেউই এই পুরস্কার পাননি। তার কন্নড় ভাষায় লেখা গল্পগুলি ইংরেজিতে সংকলন করেন দীপা ভাস্তি। তিনি এই বইটির অনুবাদ করেছেন। বুকার পাওয়ার পর বানুর উপলব্ধি, ‘মনে হচ্ছে যেন আকাশে একসঙ্গে হাজারটা জোনাকি জ্বলে উঠল’। বানু একই সঙ্গে মহিলা আইনজীবী। তিনি নারী সুরক্ষা ও অধিকার সংক্রান্ত নানা মামলা লড়েন। আইনজীবী হিসেবে তাঁর দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। তাঁর কথায়, তাঁর লেখা গল্পগুলি মহিলাদের সামাজিক, আর্থিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতিগুলি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার একটি প্রয়াস।
কর্ণাটকের হাসানে একটি মুসলিম পরিবারে বানু জন্মগ্রহণ করেন। ৮ বছর বয়সে তাকে একটি কন্নড় ভাষার মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয়,এই শর্তে যে তিনি ছয় মাসের মধ্যে কন্নড় পড়তে এবং লিখতে শিখবেন। কিছু দিন পর পড়াশোনা করে তিনি প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যান। সম্প্রদায়ের প্রত্যাশার বিপরীতে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ২৬ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। তিনি কন্নড়, হিন্দি, দক্ষিণী উর্দু এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ে মেয়েদের অধিকার, লড়াই নিয়ে সোচ্চার হতে থাকেন বানু। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি কর্ণাটকে ‘মৌলবাদ এবং সামাজিক অবিচার’ দূর করার জন্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।২০০০ সাল নাগাদ তাকে এবং তার পরিবারকে মুসলিম মহিলাদের মসজিদে যাবার অধিকারের জন্য সোচ্চার হওয়ায় তিনমাস সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অবশ্য এতে তিনি দমে যান নি। তিনি নিজের কাজ নিজের মতো করে গেছেন।
বানু একদিকে যেমন নিপীড়িত শোষিত মহিলাদের কাহিনি তাঁর গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন, তেমনই অন্যদিকে তাঁর জীবনেও রয়েছে অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাত। নিজের পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করায় নানা সময় তাঁকে সমাজের কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে। এই কটাক্ষই অবশ্য তাঁকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছে। শক্তি জুগিয়েছে লড়াইয়ের। স্কুলে পড়াকালীন প্রথম গল্প লেখেন বানু। মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালীন তাঁর গল্প লেখার যাত্রা আরম্ভ হয়। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ ৬০ বছর। কন্নড় পত্রিকা প্রজামাতায় তাঁর প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল।
বানু ছোটবেলা থেকেই লেখালেখিতে আগ্রহী ছিলেন। ২৯ বছর বয়সে তিনি মা হন ও তখন ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন, সেই সময় তিনি লেখালিখিতে মনোযোগ দেন। তিনি তাঁর অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাগুলোকে বোঝাতে এবং প্রকাশ করতে লেখালেখির পথ নেন। তাঁর লেখার অনেক অংশই নারীদের সমস্যা নিয়ে লিখিত।
বানু মুশতাক ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন, একটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধের সংকলন এবং একটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাজগুলি উর্দু, হিন্দি, তামিল, মালায়ালম, ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর “কারি নগরাগালু” গল্পের উপর ভিত্তি করে ২০০৩ সালে “হাসিনা” নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল।
হার্ট ল্যাম্প বইটি ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি৷ ইংরাজিতে অনুবাদ করা বইয়ের নাম ‘হার্ট ল্যাম্প’। বুকার পুরস্কারের জন্য ছটি বই বাছা হয়েছিল। তার মধ্যে বানু মুস্তাক অবশেষে সেরার সেরা পুরস্কার জিতে নেন। বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচারের জন্য নগদ ৫০০০০ ইউরো অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ৫৭ লক্ষ ৪৭ হাজারের মতো টাকা প্রদান করা হয়। এই অর্থ বানু মুস্তাক এবং দীপা ভাস্তির মধ্যে ভাগ হয়েছে, যিনি এই বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। মুসলিম মেয়ে এবং অন্যান্য মহিলাদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে রোজনামচা ছিল এই বইয়ের মূল বিষয়৷ ২০ মে ২০২৫ তারিখে লন্ডনে লেখিকা ও অনুবাদকারীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
বানু মুশতাক আরও অনেক সম্মান পেয়েছেন। যেমন, ১৯৯৯: কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। দানা চিন্তামণি আত্তিমাব্বে পুরস্কার। হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ বইটির জন্য পেন ইংলিশ অনুবাদ পুরস্কার, যা দীপা ভাস্তি করেন।
প্রতিবেদক : মুসকান চৌধুরী, একজন কনটেন্ট রাইটার