আমুদরিয়া নিউজ : শিলপুর নামের (কাল্পনিক নাম) একটি পাহাড়ি গ্রামের শত শত মানুষ হাহাকার করছিল দুমুঠো খাবারের জন্য। হয়ত সপ্তাহে ২ দিনই জুটত ভরপেট খাওয়া। খিদেয় প্রাণ গিয়েছে বহু শিশুর। শহরের অনেকে পিকনিক করতে যেত শিরপুরে। আর গ্রামের বাচ্চাগুলোকে দেখা যেত, পিকনিকের দল চলে গেলে তারা ডাস্টবিনে পড়ে থাকা অবশিষ্ট খাবার গুলো খাচ্ছে।
এই ছোট্ট ঘটনাটি ভাল করে পড়লে আপনি দুই রকমের পরিস্থিতির বুঝতে পারবেন। এক হল, ওই পিকনিকের দল যারা খাবার খেয়েও নষ্ট করল। আরেক দল, ওই উচ্ছিষ্টভোগী শিশুরা, যাঁদের কাছে ওটাই জীবনের যেন সব।
স্থান, চরিত্র, কাল্পনিক হলেও পরিস্থিতিটা কিন্তু ১০০ শতাংশই বাস্তব। শিলপুরের মত এমন বহু গ্রাম আজও অনাহারে কাঁদছে। আমরা তাদের নিয়ে গল্প লিখি, ভ্লগ বানাই কিন্তু এমন মানুষদের খিদের লড়াইতে যারা সর্বদা তাদের পাশে থাকেন তারাই হলেন সমাজের রত্নতুল্য মানুষ।
খিদের সংগ্রামে মানুষের জন্য লড়াই করা এমনই এক নারীযোদ্ধা হলেন অন্নপূর্ণা। না, তার আসল নাম অন্নপূর্ণা নয়, কিন্তু যেই দেবীকে আমরা অনাহার, খিদা নিবারণের দেবী বলি , যেই দেবী ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন দেয় এই নারী যে সেই দেবীরই মনুষ্য রূপ ,তা বলাটা খুব একটা ভুল নয়, তার কাহিনী শুনলে আপনিও এটাই বলবেন। উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রের আদিবাসী গ্রামে ৫২ বছর বয়সী, বিপিন দেবীর ভ্যান রান্নাঘর , যার নাম ‘চাচি কি রসোই’- সেখানের প্রায় ৬-৭ টি গ্রামের সমস্ত মানুষদের দুবেলা খাবারের দায়িত্ব নিয়েছে। কোন মানুষকে ক্ষুধার্ত থাকতে হবে না , এমনই আশা জোগায় তার রান্নাঘর। গ্রামের মানুষদের জন্য সেই রান্নাঘরই এখন জীবন। উত্তরপ্রদেশের এই অংশের অনেক গ্রামে, কৃষিকাজ এবং পশুপালনই আয়ের একমাত্র উৎস। এখানে কোনো শিল্প কারখানা নেই। আর ফসলের ফলন কম হলে, তাদের পক্ষে পরিবারের ভরণপোষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি বাচ্চাদেরও খালি পেটে দিন কাটাতে হয়। আমি তাদের দুর্দশা দেখে দুঃখিত হয়েছিলাম এবং আমার স্বামীকে এই গ্রামগুলির জন্য খাবারের পাকাপাকি ব্যবস্থা শুরু করার অনুরোধ করেছিলাম,” ছলছল চোখে এক সংবাদদাতাকে এমনই বলেছেন বিপিন দেবী। বিপিন দেবীর স্বামী কাল্লু যাদব সোনভদ্রের রাজপুর গ্রামে একটি ছোট মুদির দোকান চালান। দোকানটি তাদের দুই ছেলে নীরজ এবং মোহিত সহ চারজনের পরিবারের আয়ের উৎস। দরিদ্রদের সেবা করা এবং ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো তাদের ভাল লাগার কাজ।
দু’বছর আগে, বিপিন দেবী দরিদ্রদের দুঃখ দূর করার প্রচেষ্টায় নতুন উদ্যোগী হন। তাঁর স্বামী এবং দুই ছেলের বুদ্ধিতে একটি ফ্যামিলি ভ্যানকে রান্নাঘরে রূপান্তরিত করা হয় যাতে করে তিনি গ্রামে গ্রামে এক প্লেট ভাত ডাল আর তরকারি বিতরণ করতে শুরু করেন।
বিপিন দেবী ক্ষুধার্ত মানুষকে খাইয়ে পরম আনন্দ পান। করোনা অতিমারী চলাকালীন তারা প্রথম এই উদ্যোগটি বিস্তার করতে শুরু করেন। তারপর থেকে, তারা মাসে নিয়মিতভাবে কমপক্ষে ২০-২৫ দিন মানুষকে খাওয়ান। তারা সম্ভব হলে প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ জন লোকের কাছে খাবার পৌঁছে দেন।
কিছু বছর আগে অনেক পরিমাণ রান্না করতে গিয়ে আগুন লেগে আহত হন বিপিন দেবী। কিন্তু সহস্র ক্ষুধার্ত মানুষের অপেক্ষার কথা তার সেই ব্যথাকে ভুলিয়ে দেয়। মানুষের তার প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসাই এই কাজে তাকে বারবার সাহস জোগায়।
তার ছেলে সংবাদ দাতাকে জানিয়েছে যে, তাদের মাসিক আয়ের থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয় তাদের ও গ্রামবাসীদের খাবার এবং রান্নার অন্যান্য যাবতীয় কাজের জন্য। ছোটবেলা থেকেই মাকে মানুষের সেবা করতে দেখে আসছেন নীরজ। তিনি রান্নাঘরের গাড়িটি বিভিন্ন জায়গায় চালিয়ে নিয়ে যান। ‘চাচির রান্নাঘর’ এলেই আনন্দিত হয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার কাহিনী ভাইরাল হতেই অনেকে তাকে সাহায্যের করার জন্য অনুদান দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
যে যুগে বিলাসিতার নেশায় বহু মানুষ খাবার নষ্ট করতেও আফসোস বোধ করেন না , সেই যুগে বিপিন দেবীর মত মানুষ একটি মুদির দোকান চালিয়ে যেভাবে দরিদ্রদের সেবা করছেন তাতে সত্যিই তাঁকে মর্তের অন্নপূর্ণা বললে ভুল হবে না, এমনই মনে করেন অনেকে।
প্রতিবেদক : শিউলি ভট্টাচার্য