
আমুদরিয়া নিউজ : পাস্তা, পিৎজা অথবা টাস্কানি, পিডমন্টের মতো ওয়াইন কী আপনার বেশ পোষায় ? প্রোভোলা চিজ, আর্টিচোক কী আপনি এক নিমেষে সাবার করে দিতে পারেন ? হ্যাঁ। ইতালীয় খাবারের কথাই বলছি। এগুলি হাতের মুঠোয় পেতে একবারটি যদি আপনি ইতালিতে যান, তাহলেই তো কিস্তিমাত। বিদেশ ঘোরা হবে। আবার একটা ছোট্ট তকমা পাবেন। কিউলিনারি টুরিস্ট। দেখবেন নাকি এবার পুজোয় প্ল্যান করে ?
প্রসিউট্টো, পোলেনতা আর গলে যাওয়া কাচিওকাভালো চিজে ভরা প্লেট যদি আপনার রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে তাহলেই তো পয়সা উসুল। এ আর মন্দ কী ? তবে ইতালিতে গেলেই বা সেখানকার খাওয়ার খেলেই হল না। রয়েছে একটি সিক্রেট টিপস। সেইটাই এই প্রতিবেদনের মূল গল্প। সেটা বলার আগে একটু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখা যাক।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা UNWTO-এর তথ্য বলছে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮০ কোটির বেশি পর্যটক ভ্রমণে যান। তার মধ্যে আনুমানিক ২৫–৩০% পর্যটকের প্রধান আকর্ষণই খাবার বা কিউলিনারি ট্যুরিজম। অর্থাৎ বছরে প্রায় ২০–২৪ কোটি মানুষ সরাসরি খাবারের টানে অন্য শহর বা দেশে ভ্রমণ করেন। ইউরোপে এই হার আরও বেশি। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে প্রায় ৪০% বলেছেন যে তাদের ভ্রমণের মূল কারণ ছিল স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়া। আর ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে তালিকার শীর্ষে ইতালি। সার্ভে-ভিত্তিক ধারণা অনুযায়ী, ইতালিতে প্রতি বছর প্রায় ৬–৭ কোটি বিদেশি পর্যটক যান। আর এদের মধ্যে প্রায় ৩০–৩৫% বিশেষভাবে খাবারের অভিজ্ঞতার জন্য যান।

এবার আসা যাক সেই স্বাদ-স্বপ্নে ভরা দেশের কথায়। ইতালির কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রোম, ভেনিস বা আমালফি উপকূলের ছবি। এক একটি জায়গার এক এক অনুভূতি। কিন্তু দেশের ২৬টি ন্যাশনাল পার্কের কথা খুব কম পর্যটকের মাথাতেই আসে। অথচ এই পার্কগুলোই হল খাবারপ্রেমীদের গোপন স্বর্গ। যেখানে পাহাড়, অরণ্য, জলপ্রপাত আর শতবর্ষী গ্রাম একসঙ্গে সাজায় একেবারে সিনেমার সেটের মতো দৃশ্যপট। আর সেই দৃশ্যপটের মাঝেই জন্ম নেয় এমনসব খাবার, যা খেলে মনে হবে—“আহা! এটাই তো জীবন!” এই সিক্রেট টিপসটাই বলার ছিল। ইতালিতে গেলে পার্কগুলি অবশ্যই ঘুরে দেখার মতো। যাকে বলে মাস্ট ট্রাই।

কারণ, ইতালির পার্কগুলো একটু অন্যরকম। এখানে
সংরক্ষিত জমি মানেই শুধু প্রকৃতি নয়—এখানে আছে গরু-ছাগল চরানো, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা আঙুরের ক্ষেত, আর সেখান থেকেই উঠে আসে ‘পার্ক-টু-টেবল’ খাবার। ফলে এইসব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য ‘এনোগাস্ট্রোনমিক’ পণ্য—যা ইতালির রন্ধনশৈলীতে অমূল্য সম্পদ। একেকটা গ্রাম একেকটার জন্য বিখ্যাত।
কোথাও দুনিয়ার সেরা চিজ, কোথাও
আচার, কোথাও আবার বিনসের এমন
জাত যা খাওয়ার আগে ছবি তুলে ফ্রেমে রাখতে ইচ্ছে করে।

একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিক সম্প্রতি ইতালিতে ঘুরতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন। সেই সাংবাদিক ইভা সান্দোভাল গিয়েছিলেন ইতালির বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্ক—পার্কো নাজিওনালে দেল পোলিনোয়।

প্রায় ১ লক্ষ ৯৩ হাজার হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত এই পার্ক ক্যালাব্রিয়া ও বাসিলিকাটা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এখানে রয়েছে বিশাল বোসনীয় পাইনের বন, পাহাড়চূড়া আর ১৫শ শতকে আশ্রয় নেওয়া আর্বেরেশে নামক ইতালীয়-আলবেনীয় জনগোষ্ঠীর বসতি। বিখ্যাত খাদ্যপণ্যের মধ্যে আছে মরমানোর সাদা বিন, কাস্ত্রোভিল্লারির সাদা পেঁয়াজ, সিলা অঞ্চলের কাচিওকাভালো চিজ ও সেনেসির মরিচ।

মরমানো গ্রামে পৌঁছে প্রথমেই দেখা মেলে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন। ফ্রাসচিনেতোর ধ্বংসাবশেষ, যা অনেকের মতে প্রাচীন সৌর ঘড়ি। এরপর স্থানীয় ত্রাত্তোরিয়ায় দুপুরের খাবার—প্রসিউট্টো, পোলেনতা আর গলে যাওয়া কাচিওকাভালো চিজে ভরা প্লেট। বিশাল পাইনের জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে পথে দেখা মেলে পোডোলিকা গরুর পালের।

তবে আসল চমক মিলল
চিভিতা শহরে, রেস্তোরাঁ
কামাস্ত্রায়। শুরু হল পেঁয়াজের আচার, ফাভা বিন ও কিউব করে কাটা প্রসিউট্টো দিয়ে। তারপর কাভাতেল্লি পাস্তা রিকোটা ও
স্থানীয় নেটলস দিয়ে মাংসের ঝোল আর শেষে আর্বেরেশে ডেজার্ট। ক্রুস্টুল, মধু ও দারুচিনিতে ভরা ভাজা ময়দার রোল।

ইভা ফেরার আগে শপিং ব্যাগ ভরে নিলেন সাদা বিন, ডাল, চকোলেটে মোড়া বাদাম-ডুমুর, ক্যাপ্রিনো চিজ, আর এক বোতল সাদা ও লাল ওয়াইন। বাড়ি ফিরে বিন ভিজিয়ে টমেটো, রসুন, পেপেরোনচিনো দিয়ে রান্না করতেই বেরিয়ে এল মাখনের মতো নরম স্বাদ। রান্না করতেই বুঝলেন এই স্বাদ শুধু খাবারের নয়, এটা যেন এক টুকরো ইতালি। কারণ এখানে প্রতিটি বাইটে মিশে আছে পাহাড়ি হাওয়া, রোদ, আর শত বছরের ভালোবাসা।

ইতালির ন্যাশনাল পার্কগুলো তাই শুধু প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য নয়—এগুলো রসনা অভিযাত্রীদেরও স্বপ্নের ঠিকানা। এখানে প্রতিটি বাইটে একেকটি গল্প তৈরি হয়।
সেই গল্পের স্বাদ মুখে লেগে থাকে। আহা!
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী, আমুদরিয়া নিউজে ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।