
সাধারণ মানুষের স্বপ্ন যেখানে একটা ছোট ছুটি কাটাতে কোনও সমুদ্র সৈকতে যাওয়া, সেখানে ধনকুবেরদের ছুটি মানেই এক বিশাল ভাসমান প্রাসাদে ঘোরা। সেই প্রাসাদ হল সুপারইয়াট বা ব্যয়বহুল প্রমোদতরী! হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। প্রমোদতরীতে ঘোরাই হল বিলাসিতার এক অনন্য নমুনা। কে জানে। হয়তো স্থলের ব্যস্ত জীবনযাত্রার চাইতে অকুল জলের মাঝে নির্বিবাদ ট্রাঙ্কুইলিটির পিছু ধাওয়া করতেই হয়তো প্রভাবশালীদের মন মানে। তিমির পাশে ভেসে চলা কিংবা ফিজির জেলেদের হাত নাড়ানো দেখা হয়তো মনের সেই না বলা কবিতার জন্ম দেয়। সবটাই আনন্দের, কিন্তু নিরাপদ। গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই, শশব্যস্ত জীবনের বোঝাপড়া নেই। আছে শুধুই অপরিসীম নীলের হাতছানি।

তবে দৃষ্টির দিক দিয়ে ভাবতে গিয়ে কিন্তু বিলাসিতার সঠিক পরিমাপ করা যাবে না। কারণ, এই প্রমোদতরীগুলো একেকটা যেন সমুদ্রে ভাসমান পাঁচতারা হোটেল। নামেও সুপার কথাটা আছে। ইয়াটকে প্রমোদতরী বলা যায়। কিন্তু সুপারইয়াট বললে বুঝতে হবে ব্যয়বহুল প্রমোতরী। ইয়া বড়ো এক একটার সাইজ। বিলাসবহুল রান্নাঘর, ঝাঁ চকচকে বাথরুম, শেফ বা কুক, পর্যাপ্ত ক্রু মেম্বার সবই বর্তমান সেই আয়োজনে। করোনার সময় দেখা গিয়েছিল, এই প্রমোদতরীর বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। কারণ, ভোগ্য সব সুবিধার সঙ্গে সপরিবারে জনবহুলতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল এই প্রমোদতরী। তবে সবটাই ওই প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ কিন্তু ভিড়ের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, বড় ধনীদের মধ্যে এখন মার্কিনরা সবার আগে। তবে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকোর লোকজনও ধীরে ধীরে এই রাজ্যে ঢুকে পড়ছেন। রাশিয়ান ক্রেতাদের সংখ্যা কমেছে ইউক্রেন যুদ্ধের পর নিষেধাজ্ঞার কারণে।

এখন আসা যাক সুপারইয়াটের নোম্যানক্লেচারে। সুপারইয়াট মানে কী ? এক কথায়, ২৪ মিটারের বেশি লম্বা, প্রাইভেট মালিকানাধীন, বিলাসবহুল এবং পেশাদার ক্রু দ্বারা চালিত ইয়াট। এগুলোর দাম ? হালকা মাথাও ঘোরানো যাবে না। ছোট ইয়াটের দাম শুরু ৩৬০ কোটি টাকা থেকে। আর বিশাল ১০৫ মিটারের বিলাসী ইয়াটের দাম ৩০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। হেলিপ্যাড থেকে শুরু করে সিনেমা হল, সাওনা, বিউটি সেলুন। আপনি হয়তো হাতে গুনেও অত সুবিধার নাম বলতে পারবেন না। কিন্তু সব থাকে ভেতরে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক সুপারইয়াট তৈরি হয় ইতালিতে। ২০২৩ সালে ইতালির ইয়াট শিল্প আয় করেছে ৮৩ হাজার কোটি টাকা। তাও আবার কারিগরি দক্ষতা আর স্থানীয় শিল্পীদের দক্ষতায়।

করোনার সময় হোটেল-রিসর্ট বন্ধ, ধনীদের ঘুরতে যাওয়ার উপায় নেই। তখনই বুদ্ধি—‘আপনিই নিজের হোটেল কেন কিনে নেন না?’ ব্যস, শুরু হয়ে গেল সুপারইয়াট কেনার হিড়িক! ২০২২ সালে এক ধাক্কায় ১,০২৪ টি সুপারইয়াট অর্ডার হয়। ২০২৩-এ সেটা বেড়ে হয় ১,২০৩ টি। ইতিহাস ঘুরে গেল। প্রথম এমন চাহিদা দেখা গেল। ইতালির ‘আমের’ নামক ইয়াট সংস্থার কর্ণধার বারবারা বলেন, ‘করোনার পর মানুষ বুঝেছে—নিজের জায়গা, নিজের স্বাধীনতা অনেক দামি।’ তাই ইয়াটে চাই বিশাল জানালা, খোলা ডেক আর সমুদ্র ছোঁয়ার মতো ব্যবস্থা। চলতি বছর ইয়াটের সংখ্যা একটু কম হতে পারে। ১,১৩৮টি। কিন্তু সাইজে তারা আগের থেকেও বড়। ৭৬ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের ইয়াট এখন ৬১টি তৈরি হচ্ছে। যেখানে গত বছর ছিল ৫৫টি। আর ২৪-২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের ছোট ইয়াটের বিক্রি কমেছে। সবাই এখন ‘বড়া হ্যায় তো ব্যহতর হ্যায়’ নীতিতে চলেছেন।

তালির পাওলা ত্রিফিরো ও তাঁর স্বামী এমনই দম্পতি, যাঁরা আজ পর্যন্ত এক বা দু’টো নয়—১২টারও বেশি সুপারইয়াটের মালিক ছিলেন। দুজনেই আইনজীবী, আর নিজেদের তৈরি করা আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা চালিয়েই তাঁরা এই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এখন তাঁদের নেশা হলো বিশ্বজুড়ে বিলাসবহুল ইয়াটে ঘোরা। পাওলা বলেন, তাঁদের ইয়াট এমন ভাবে তৈরি যা কোনও অভিজাত হোটেলকেও পিছনে ফেলে দেবে। প্রমোদতরীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ? রান্নাঘর। তিনি বলেন, ‘আমি এমন রান্নাঘর চাই, যেখানে রাঁধুনি ১৫ জনের জন্য রাজকীয় খাবার তৈরি করতে পারে। কারণ সব জায়গায় ভালো রেস্তোরাঁ পাওয়া যায় না!’ তাঁর মতে, বড় ইয়াট মানেই বড় নিরাপত্তা। আর সবশেষে পাওলার একটা মজার কথায়, ‘আমি নিজে ইয়াট চালাই। নতুন জায়গা ঘোরার কৌতূহল আমাকে স্টিয়ারিং ধরে সমুদ্রে টেনে নিয়ে যায়!’ তাঁর ক্যাপ্টেন ২২ বছর ধরে কাজ করছেন, আর ক্রুদের বেতনও দ্বিগুণ। কারণ তাঁর মতে, ‘ওদের খুশি রাখাটাই আসল বিলাসিতা।’
এই হল ধনীদের জগতে সুপারইয়াটের রঙিন গল্প। গরীবের সিনেমা, ওদের জন্য বাস্তব।
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী, ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।