আমুদরিয়া নিউজ : ১৯৯৪ সালে, ৩৯ বছর বয়সী লিন্ডা লিমিং প্রথমবার ভুটানে এসে মুগ্ধ হয়ে যান। হিমালয়ের কোলে থাকা এই ছোট্ট দেশটির প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর শান্ত পরিবেশ তাকে আকর্ষণ করে। ন্যাশভিলের একজন লেখকের ব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে কিছুদিনের জন্য ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি। ভুটানের সুন্দর পাহাড়, সবুজ বন আর বৌদ্ধ মঠগুলো তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়।
পারো শহরে প্লেন থেকে নামার পরই লিন্ডা অবাক হয়ে যান। পাহাড়ের গায়ে টাইগার্স নেস্ট মঠের সোনালি ছাদ দেখে তাঁর মনে হচ্ছিল যেন কোনো কল্পনার জগতে চলে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানকার বাতাস এখনও খুব বিশুদ্ধ। ভুটান বিশ্বের একমাত্র কার্বন-নেগেটিভ দেশ, কারণ এখানে প্রচুর গাছ আছে।’
লিন্ডা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যেই মুগ্ধ হননি, ভুটানের মানুষের আতিথেয়তাও তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। একবার পথে হাঁটতে গিয়ে পায়ে আঘাত পাওয়ার পর একজন মোটরসাইকেল চালক তাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আবার লিন্ডাও পথে চলতে চলতে মানুষের মধ্যে ফল বিতরণ করতেন।
প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটা লিন্ডার জন্য এক ধরণের মেডিটেশনে পরিণত হয়। তিনি বলেন, ‘আমার মন শান্ত হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি বাকি জীবন এখানেই কাটাতে চাই।’
ভুটানে নতুন জীবন ও প্রেম
ভুটান থেকে ফিরে লিন্ডা আমেরিকায় বাড়ি কেনার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ভুটানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিন বছর পর, তিনি সব কিছু ছেড়ে ভুটানে চলে আসেন। থিম্পুতে একটি স্কুলে চাকরি পান তিনি। সেখানে নামগে নামের একজন শিল্প-শিক্ষকের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। নামগে ছিলেন লাজুক কিন্তু খুব ভাল মানুষ। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নেয়। একদিন নামগে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। লিন্ডা অবাক হলেও রাজি হয়ে যান। ২০০০ সালে তারা বিয়ে করেন।
মজার ব্যাপার হল, বিয়ের কয়েক বছর পর নামগে লিন্ডাকে বলেন, তিনিই সেই মানুষ যিনি লিন্ডাকে মোটরসাইকেলে করে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রথম ভুটান সফরে! লিন্ডা বলেন, ‘এটা নিয়তির খেলা।’
তাদের দাম্পত্য জীবনে আরও সুখ আসে, যখন তারা কিনলে নামের এক মেয়েকে দত্তক নেন। কিনলে এখন অস্ট্রেলিয়ায় নার্সিং পড়ছেন। লিন্ডা বলেন, ‘আমি কখনও ভাবিনি আমার সন্তান হবে, কিন্তু এটা সত্যিই এক আশীর্বাদ।’
গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস।
ভুটানের বিশেষত্ব হল, এখানে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ বা জাতীয় সুখের ধারণা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে মানুষের সুখকেই এখানে বেশি মূল্য দেওয়া হয়। লিন্ডা বলেন, ‘ভুটানে সময়ের ধারণা আলাদা। এখানে কাউকে বললে ‘বুধবার আসবেন’, এর মানে সেদিন বা পরের দিন যে কোনো সময় আসতে পারেন। এইরকম আতিথ্যেয়তায় আমেরিকানদের অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। কিন্তু এটি আসলে খুব সুন্দর একটি জীবনযাপন পদ্ধতি।’
লিন্ডা এখন থিম্পুর পাহাড়ে একটি সুন্দর বাড়িতে থাকেন। তার স্বামী নামগে একজন শিল্পী, যিনি ঐতিহ্যবাহী ভুটানি শিল্পের সাথে আধুনিক জিনিস মিলিয়ে ছবি আঁকেন। লিন্ডা ভুটান নিয়ে দুটি বইও লিখেছেন।
তিনি বলেন, ‘ভুটান প্রকৃতির মধ্যে ডুবে থাকা একটি জায়গা। এখানে মানুষ উদারতাকে মূল্য দেয়। আজকের বিশ্বে যেখানে এত রাগ আর ভয়, ভুটান যেন এক শান্তির মরূদ্যান।’
লিন্ডার গল্প প্রমাণ করে, নিজের হৃদয়ের কথা শুনলে জীবন কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে!
প্রতিবেদক : অরিৎ চক্রবর্তী, আমুদরিয়া নিউজে ভিডিও এডিটিং ও কপিরাইটিং বিভাগে যুক্ত।