আমুদরিয়া নিউজ : কাশ্মীরে সহ গোটা ভারতবর্ষ এখন শোকাহত। কিন্তু, এই শোক ও কষ্টের মাঝেই যেন সকলের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাশ্মীরি ভারতীয়রা। গতকাল আপনাদের বলেছিলাম কীভাবে সেখানে ট্যাক্সি চালকরা পর্যটকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের বিনামূল্যে পরিষেবা দিচ্ছেন এমনকি নিজের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ও দিয়েছেন। আজ আপনাদের এমন একজনের কথা বলব যে বয়সে ছোট হলেও তাঁর মনটা অনেক বড়। সে তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই আজ গোটা দেশবাসীর মন জিতে নিয়েছে।
মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়ে বৈসারণে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক জঙ্গি হামলায় গুলির আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আলাদা আলাদা জায়গায় থাকা পর্যটকরাও ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু, সেই আতঙ্কের মুহূর্তেই সকলের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানের গুজ্জর বসতির এক কিশোরী।
কাশ্মীরের রেবিট গার্ল হিসেবে পরিচিত ১৬ বছর বয়সী মেয়ে রুবিনা। সে মাত্র কয়েক টাকার বিনিময়ে পর্যটকদের সাথে তাঁর পোষা খরগোশটির ছবি তুলতে দেয়। আজ সেই মেয়েই এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সময় সকলের মন জয় করেছে। সেই ঘটনার দিন রুবিনা চেন্নাই থেকে আসা এক দম্পতির সেখানে গিয়েছিল।
রুবিনা সংবাদ দাতাদের জানায়, তাঁরা দুপুর ২ টায় বৈসারণ পার্কে পৌঁছায়। পর্যটকরা ছবি তোলার সময় গুলির শব্দ পান। তাঁরা ভেবেছিলেন সেটা আতশবাজির শব্দ। কিন্তু, সকলকে ভয়ে পালিয়ে যেতে দেখলে তাঁরা ঘটনাটা আঁচ করতে পারেন। দিনটি সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীরের সবচেয়ে অন্ধকার দিন।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে রুবিনা আড়ালের জন্য দৌড়ে পালায়। কিন্তু, তাঁর নিজের জন্য চিন্তা ছিল না, সে আবার পার্কার গেটে ফিরে যায় তাঁর সাথে থাকা পর্যটকদের খুঁজতে। কেউ বুঝতে পারছিল না এমন কিছু কি করে হল। সকলে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন।
শরীরে ক্লান্তি, চোখে জ্বল আর মনে ভয় নিয়ে যখন পর্যটকরা পাহাড় থেকে নেমে আসছিল তখন রুবিনা তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে নিজের বাড়ির দরজা খুলে দেয়। তাঁদের বাড়িটি পার্ক থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছিল। রুবিনার সাথে তাঁর ১৭ বছর বয়সী দিদি মুমতাজও ছিল।
তাঁদের বাবা, গোলাম আহমেদ আওয়ান, গুলির আওয়াজ শুনে ভীষণ ভয়ে পেয়েছিলেন। তিনি বৈসারণে গাইড হিসেবে কাজ করতেন। তিনি তাঁর বাড়ির সকলকে পার্কের কাছে যেতে মানা করেন। তিনি জানতেনও না যে তাঁর মেয়ে আদেও বেঁচে আছে কিনা। মুমতাজ ও রুবিনাকে বাড়ি ফিরতে দেখে তিনি স্বস্তি পান।
তিনি বলেন, কাশ্মীরের পর্যটন শ্বাস নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু এই বর্বর ঘটনা সবকিছু শেষ করে দিল। এখন তাঁদের জীবিকা সম্পূর্ণ ধসে গেল। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রেকর্ড ১২,০০০ পর্যটক সেই উপত্যকায় ঘুরতে এসেছিল। সকলেই এটা নিয়ে ভীষণ খুশি ছিলেন। কিন্তু, এই ঘটনা সেই আনন্দকে বেশিদিন টিকতে দিল না।
মঙ্গলবারের মর্মান্তিক ঘটনার পর, কাশ্মীরিরা শোকে একত্রিত হয়েছে। উপত্যকা জুড়ে নীরব প্রতিবাদ, মোমবাতি মিছিল, বন্ধের ঘোষণাও করা হয়। পাহেলগামে, হোটেল, দোকানদার সকলেই- পর্যটনের ওপর নির্ভর করেন। সেখানের স্কুল, দোকান সব বন্ধ।
রুবিনার আগের একটি ছবির সাথে এখনের একটি ছবি পোস্ট করে অনেকেই লিখেছেন, এক সময়ের সেই ছোট মেয়েটা আজ বয়সে খুব বেশি বড় না হলেও সে এক বড় কাজ করছে। এখন রুবিনাই সকল পর্যটক তথা কাশ্মিরবাসীদের মনেও সাহস জোগাচ্ছে। রুবিনা তাঁর চোখে এক ভয়াবহ দিনের স্মৃতি নিয়ে ঘুরছে। সে সেই দিনের কথা গুলিই বার বার মনে করছে। সে তাঁর খরগোশকেও হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর পরিবারও এক কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এত সবের মাঝেও যেই উপত্যকা, যেই পাহাড়কে সে নিজের বাড়ি বলে,সেও ওই পাহাড়ের মতই নিজের মনকে শক্ত করে রেখেছে। তাঁর আশা ও বিশ্বাস এখন একটাই। সে জানায়, সে শুধু চায় শান্তি ফিরে আসুক। মানুষ আবার এই পাহাড়ে এসে ভিড় জমাক। ভয়ে নয়, হাসিমুখে।